শারীরিক ব্যয়াম সম্পর্কে দার্শনিকেরা কী বলেন

এমন বলা হয়ে থাকে প্রাচীন গ্রীসে অলিম্পিকের জন্য ওরা জিমনেশিয়াম বানিয়েছিল, শরীরচর্চার জন্য, কিন্তু বেরিয়ে এলো দার্শনিকেরা।

কথাটি হয়ত অভার-জেনারালাইজেশন। কিন্তু, এই কথা আসলে বুঝাতে চায় শরীরের সাথে মনের সম্পর্কে, চিন্তার সম্পর্ককে। ট্রেইনিং বডি মাইন্ড ট্রেইন করার সাথে যুক্ত।

পশ্চিমা দর্শনের সর্ববৃহৎ স্তম্ভ প্লেটো সম্পর্কে বলা হয় তার নাম প্লেটো ছিল না। তিনি যুবক বয়সে শরীরচর্চা করতেন। তার কাঁধ এত চওড়া হয়েছিল যে শরীরচর্চার শিক্ষক নাম দেন প্লেটো, অর্থাৎ চওড়া কাঁধ যার। অনেকে মনে করেন প্লেটো অলিম্পিকে খেলাতে অংশ নিয়েছেন ও স্বর্ণপদক জিতেছেন। কিন্তু এই অনুমান প্রশ্নাতীত নয়।

শরীরচর্চার ক্ষেত্রে একটা প্রাথমিক বিষয় হলো বিভিন্ন ধরণের মাসকুলারিটি সম্পর্কে ধারণা। যেমন, স্ট্রং ম্যানদের বডি যদি দেখেন, দেখবেন তাদের শরীরে অনেক চর্বি। দেখলে মনে হয় ফ্যাট একটা লোক। কিন্তু এর নিচে মাসল রয়েছে। তাদের মাসল দেখা যায় না ফ্যাটের লেয়ারের কারণে।

২০১৭ সালের স্ট্রংম্যান প্রতিযগিতা জেতা এডি হল। ১৮৬ কেজি ওজন। ডেডলিফট করতে পারেন ৫০০ কেজি।

রোমান গ্ল্যাডিয়েটর যোদ্ধারা গবেষকদের মতে খুব সম্ভবত এরকম ছিল। ফিল্মে রাসেল ক্রো’কে যেভাবে দেখানো হয়, এরকম ডিফাইনড বডি তাদের ছিল না। কারণ যুদ্ধে তরবারির আঘাত প্রায়ই তাদের শরীরে লাগতো। এক্ষেত্রে ডিফাইনড বডি হলে মাসল কেটে যাবে। গ্ল্যাডিয়েটরদের চর্বির লেয়ার থাকতো উপরে, তাই আঘাতটি এর উপর দিয়েই যেত।

ডিফাইনড বডি হচ্ছে, ওয়েট কম থাকলেও মাসলগুলো আলাদা আলাদা ভাবে দেখা যায়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে চমৎকার উদাহরণ হলেন ব্রুস লী। ব্রুস লি’র ওজন ছিল মাত্র ৬০ কেজির মতো। কিন্তু মাসলগুলো স্পষ্টভাবে ডিফাইনড।

ছবিঃ ব্রুস লী।

আপনি যখন জিম শুরু করবেন তখন আপনাকে ঠিক করতে হবে কীরকম বডি আপনি করতে চান। বেশী মাসল করার কস্ট অনেক, এগুলি ধরে রাখতে। আপনি যদি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন তাহলে বেশী মাসল করতে পারেন। কিন্তু ডিফাইনড বডি, ওয়েট কম, এই জিনিসটা অনেকটাই ভালো।

ছবিঃ প্রাচীন গ্রীসের একজন বক্সারের ডিফাইনড বডি। (৩০০-২০০ বিসিই)

বডি কী এ নিয়ে জর্মন দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের একটি কথা আছে। তার কথা হলো, আমাদের একটি বডি আছে জিনিসটা এমন নয়। আমাদের বডিটি এমন কোন বস্তু নয় যা আমরা সাথে সাথে রাখি, যেমন খাপে ভরা ছুরি। বরং আমাদের বডিটাই আমরা।

এখানে হাইডেগার যে পয়েন্টটা দেখাতে চান তা হলো, একজন তার বডিকে ছেড়ে যেতে পারবেন না, বা নিজের থেকে আলাদা করে দেখতে পারেন না তিনি। বডিতে কোন কিছুর প্রভা পড়বে আপনার সেলফে।

আরেকজন দার্শনিক রুশো। তাকে আমার জিন জ্যাক রুশো বলতে ভালো লাগে ইংরাজি উচ্চারনে, যদিও তার নামের উচ্চারন বাংলায় লেখা হয় জ্যঁ জ্যাঁক রুশো। রুশো বলেছিলেন এমন একটি কথা যা এই আধুনিক যুগে আমাদের জন্য চিন্তার উদ্রেককারী হতে পারে।

প্রাচীন মানুষ জঙ্গলে থাকতো। সে হাত দিয়ে শিকার করত, গাছের ডাল ভাঙতো, দৌড়ে যেত পা দিয়ে। রুশো’র মতে হাতই মানুষের মূল যন্ত্র ছিল। কিন্তু এরপর মানুষ নানা যন্ত্র বের করলো। তার কাছে গাছের ডাল কাটার অন্য যন্ত্র আছে তখন সে কি আর হাত দিয়ে ডাল ভাঙবে? তার কাছে পাথর ছোঁড়ার অন্য যন্ত্র আছে তখন সে কি আর হাত দিয়ে ডাল ভাঙবে? এইভাবে আধুনিক মানুষ তো এগিয়ে গেল, এবং ওই প্রাচীন মানুষের সাথে প্রতিযোগীতায় নামালে সে অনেক এগিয়ে থাকবে তার যন্ত্রের খাতিরে। কিন্তু রুশো বলেন, যন্ত্র ছাড়া ন্যাকেড দুই পক্ষকে দাঁড় করালে কী হবে? তখন ঐ প্রাচীন লোকটির কাছে কিন্তু আধুনিক লোকটি পারবে না।

রুশো’র পয়েন্ট এখানে হচ্ছে, যন্ত্র নির্ভরতা আমাদের যন্ত্রে পারদর্শী করছে ঠিক আছে, কিন্তু আমাদের কোর শক্তিকে বিকশিত করছে না। বরং ব্যবহার না হতে থাকায় সেই শক্তি মিইয়ে যাচ্ছে জেনারেশন বাই জেনারেশন। আধুনিক যন্ত্রনির্ভরতার যুগে রুশোর এইকথাটি আমাদের সতর্ক করতে পারে যন্ত্রের অতিব্যবহার বিষয়ে, এবং নিজের কোর শক্তি তথা শারীরিক ও মানসিক শক্তিকে অতি-অবহেলা না করার ব্যাপারে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *