আনারসের বিস্ময়কর ইতিহাস
১৪৯৩ সালের নভেম্বরে আনারসের সাথে ইউরোপিয়ানদের প্রথম সাক্ষাত হয়। ক্যারিবিয়ান দ্বীপ গুয়াদালোপের কারিব নামক গ্রামে কলম্বাস ও তার নাবিকেরা ফলটাকে দেখতে পান। এই ফলের উৎপত্তি অবশ্য দক্ষিণ আমেরিকায়, কিন্তু ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে পৌছে গিয়েছিল।
কলম্বাসের কাছে ফলটি আকর্ষনীয় লাগল। তারা খেয়েও দেখলেন ভালো। ফলে ইউরোপে নেয়ার ব্যবস্থা করা হলো।
ছবিঃ ছবিতে দেখা যাচ্ছে দ্বিতীয় চার্লসকে আনারস দেয়া হচ্ছে। ১৬৭৭ সালের।
কিন্তু দেখা গেল আনারস ইউরোপে নেয়া বা ইউরোপে চাষ করা খুবই কঠিন। সেই সময়ে আনারস হয়ে উঠল দারুণ আভিজাত্যের প্রতীক। কেবল রাজা রানীর বা সম্ভ্রান্ত পরিবার আনারস খেতে পারতেন। তবে খাওয়াটা আর মূখ্য থাকলো না। আনারস থাকলে তা প্রদর্শন করা আভিজাত্য প্রকাশক চিহ্ন হয়ে উঠল।
ছবিঃ তৃতীয় উইলিয়াম কেনিংস্টন প্যালেসের জন্য এই ওক কাঠের টেবিলটি বানিয়ে নেন। এর উপরে রূপার প্রলেপ দেয়া। এটি বানানো হয় ১৬৯৮ সালে। এর নিচের দিকে রয়েছে আভিজাত্য প্রকাশক স্বর্গীয় ফল আনারস।
মানুষ একটি আনারস পেলে তা পচন ধরার আগ পর্যন্ত প্রদর্শনের জন্য রেখে দিত, নিজেদের উচ্চ সামাজিক মর্যাদা দেখানোর জন্য।
১৭ শতকে একটি আনারসের দাম ছিল বর্তমান হিসাবে প্রায় পাঁচ হাজার ডলার।
রাশিয়ার ক্যাথরিন দ্য গ্রেট, ইংল্যান্ডের দ্বিতীয় চার্লস ছিলেন আনারসের বড় ভক্ত।
মধ্য ১৮ শতকে আনারসের খ্যাতি তুঙ্গে পৌছে। আনারস নিয়ে কবিতা লেখা হলো। অভিজাতরা সন্ধ্যার মিটিং এ মিলিত হলে আনারস প্রদর্শন করা হতো।
১৭৬১ সালে ডানমোরের চতুর্থ আর্ল স্কটিশ এস্টেটে আনারসের সম্মানে একটি টেম্পলই নির্মান করে বসেন, এমনই ছিল আনারসের খ্যাতি।
ছবিঃ চতুর্থ আর্ল অব ডানমোরের বানানো আনারস টেম্পল।
ক্রিস্টোফার রেন সেইন্ট পলের দক্ষিণ টাওয়ারের চূড়া নির্মানের সময় সেখানে স্বর্গীয় ফল আনারসকেই বসিয়ে দিয়েছিলেন।
ছবিঃ সেইন্ট পল ক্যাথেড্রালের দক্ষিণ টাওয়ার, ক্রিস্টোফার রেন, ১৭১১
১৯ শতকের শেষে এসে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হয়, এবং হাওয়াইতে বড় বড় আনারসের বাগান হয়। ফলে আস্তে আস্তে আনারস সহজলভ্য হয়ে ওঠে। মানুষও একে আর আভিজাত্যের প্রতীক বলে মনে করে না। আনারসের দাম কমে যায়। পরে কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) লিখেই ফেলেন, ‘আনা দরে আনা যায় কত আনারস।”
বাংলায় আনারস
বাংলায় আনারসের আগমন হয় পর্তুগিজদের হাত ধরে। পর্তুগিজরা প্রথম ইউরোপিয় হিসেবে বাংলায় আসে ১৫১৬ খ্রিস্টাব্দে।
পর্তুগিজ “আনানাস” থেকেই বাংলা আনারস শব্দের উৎপত্তি।
আনারসের মুগ ডাল, আনারসের রস দিয়ে লুচি পরোটা ইত্যাদি খাবারও হয়েছে বাংলায়।
ওয়ার্ক-আউটে আনারস
ওয়ার্ক আউটের জন্য যে শক্তির দরকার হয়, তা আনারস থেকে একজন পেতে পারেন। এক কাপ আনারসে ২২ গ্রাম কার্ব থাকে, এবং তা সিম্পল সুগার ফর্মে। ফলে তা দ্রুত শক্তি উৎপন্ন করতে পারে।
আনারাসের মধ্যে ব্রমেলেইন থাকে, যা হজমে সাহায্য করে।
অন্যান্য কয়েকটি মাইক্রো-নিউট্রিয়েন্টস এর সাথে সাথে আনারস ভিটামিন সি এবং ম্যাঙানিজের দারুণ উৎস। ভিটামিন সি এবং ম্যাঙানিজ দুটিই শক্তিশালী এন্টি-অক্সিডেন্ট। জিমের এক্সারসাইজে মাসলের উপর স্ট্রেস পড়ে। এন্টি-অক্সিডেন্ট এই স্ট্রেস কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের রিকমেন্ডেশন অনুযায়ী এন্টি-অক্সিডেন্ট সাপ্লেমেন্ট থেকে না নিয়ে ফুড থেকে নেয়া ভালো। তাই আনারস হতে পারে এন্টি-অক্সিডেন্টের এক সহজ সমাধান। এছাড়া ম্যাঙানিজ হাড়ের শক্তি এবং রিকভারির কাজে লাগে।
ভিটামিন সি এর আরেকটি ভালো উৎস কমলালেবু। কমলালেবু নিয়েও এই ব্লগে একটি লেখা আছে, আগ্রহীরা পড়তে পারেন।
আনারস নয়া ইতিহাসের সূত্র
একটা বিতর্ক আছে, ১৪৯২ সালের আগে ইউরোপিয়ানদের সাথে আমেরিকানদের দেখা হয়েছিল কি না এ নিয়ে। অনেকে বলে থাকেন প্রাচীন গ্রীস-রোমের লোকদের কাছে আমেরিকা পরিচিত ছিল। এ মতের একজন সমর্থক ইতালিয়ান ফিজিসিস্ট ও ফিলোজিস্ট লুসিও রুশো।
ছবিঃ রোমান এরার এই ভাস্কর্য ও ফিয়াস্কোতে দেখা যাচ্ছে আনারস। স্ট্যাচুটি খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের।
প্রাচীন কিছু আর্ট-ভাস্কর্যে আনারসের ছবি মিলে। কিন্তু আনারসের উৎপত্তি তো দক্ষিণ আমেরিকায়। দক্ষিণ আমেরিকার ফল প্রাচীন গ্রীসে গেলো কীভাবে আর ভাস্কর্যে স্থান পেল কীভাবে, এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ন হয়ে উঠে। এরকম আরো কিছু প্রমাণের ভিত্তিতে লুসিও রুশোর মতো কিছু স্কলার বলেন ইউরোপিয়ানদের সাথে আগেই আমেরিকানদের সংযোগ হয়েছিল।
আনারসের ম্যাজিক
এ পর্যন্ত পড়েও যারা আনারসের ম্যাজিক ধরতে পারেন নি তাদের জন্য সাম্প্রতিক একটি ঘটনার কথা বলতেই হচ্ছে। আশা করি আপনারা এতে আনারসের মাহাত্ম্য সহজেই বুঝে ফেলতে সক্ষম হবেন।
২০১৭ সালের মে মাসে স্কটল্যান্ডের আবিরদিনের রবার্ট গর্ডন ইন্সটিটিউটে একটি শিল্প প্রদর্শনী হচ্ছিল। আবিরদিনের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরতেই এই আয়োজন।
দুই আনারস প্রেমিক ছাত্র মজা করে দোকান থেকে একটি আনারস কিনে সেই প্রদর্শনী কক্ষের এক টেবিলে রেখে চলে গিয়েছিলেন।
কয়েকদিন পরে তারা ফিরে এসে দেখতে পেলেন ম্যাজিক। আনারসকে গ্লাস দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে এবং শিল্প বস্তু হিসেবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। দর্শকেরা বিস্ময়ে বস্তুটি দেখছেন, তার সাথে ছবি তুলছেন।
সুতরাং, আনারস অবশ্যই ফেলনা বস্তু নয়। সবার অলক্ষ্যে, যেকোন সময়ে সে শিল্পে পরিনত হবার ক্ষমতাও রাখে।
দারুণ কাহিনী তো! মজাও পেলাম। সাথে আফসোসও হচ্ছে আম্মা-আব্বা কত বলেন আনারস খেতে। আমি খাই না সহজে। এই ফলে এত গুণ আর এত ব্যাকস্টোরি! জোস!