বুদ্ধিবৃত্তিক কাজের সাথে ব্যায়াম যায় না এমন একটি মিসকনসেপশন আছে। এই মিসকনসেপশনের মূলে মানুষের চিন্তা বিষয়ক একটি ভুল ধারণা জড়িত। মানুষ কেবল তার ব্রেইন না, যদিও ব্রেইন দিয়ে সে চিন্তা করে। মানুষ হলো তার পুরা শরীর এবং তার চারপাশ যা তার উপর প্রভাব ফেলতে পারে তা মিলে একটা সিস্টেম। এই সিস্টেমই তার চিন্তা তৈরি করে। প্লেটো, হেইডেগার, রুশোর মতো দার্শনিকেরা এক্সারসাইজকে পজেটিভ হিসেবেই দেখেছেন।
ব্যায়াম মানুষের জন্য দরকারি কারণ মানুষ বিবর্তনগত ভাবে বসে থাকার জন্য তৈরি হয় নি। ফলে বসে থাকা তার কর্মক্ষমতাকে ধীরে ধীরে কমিয়ে দেয়।
মানুষের ভিতরে যে হরমোনাল সিস্টেম আছে (এন্ডোক্রিন সিস্টেম) এতে হরমোনের একটা ভারসাম্য দরকার হয় তার বেড়ে উঠা, আচার আচরণ ইত্যাদির জন্য। যেমন, কোন পুরুষ লোকের টেস্টোস্টেরন কম হলে তার নানা সমস্যা হতে পারে। টেস্টোস্টেরন কেবল সেক্স হরমোন না, এটা একটা মেইন হরমোন। স্যাডনেস, ডিপ্রেশন, স্মৃতি সমস্যায় হতে পারে এর কারণে। বিজ্ঞানি রবার্ট সাপোলস্কি এ নিয়ে ইন্টারেস্টিং আলোচনা করেছেন, আপনারা চাইলে তা দেখতে পারেন। ভিডিও আছে এখানে আর নিচে বইয়ের ছবি।
এই টি-লেভেল বাড়ানোর জন্য সবচাইতে সেরা উপায় হলো এক্সারসাইজ, বিশেষত ওয়েট লিফটিং। কারণ টি ছাড়া মাসল ম্যাস হয় না, ফলে মাসলে প্রেশার পড়লে টি বুস্ট হয়।
পৃথিবীতে যেসব জিনিয়াসেরা ছিলেন তারা কেউই ব্রেইনকে আলাদা ভাবে ভাবেন, বরং নিজেদের একটা সিস্টেম হিসেবে ভেবেছেন।
ইংলিশ পলিম্যাথ এল্যান টিউরিং ছিলেন ভালো মানের দৌড়বিদ। তিনি দৌড়ের জন্য মারাত্মক পরিশ্রম করতেন। ১৯৪৮ সালের অলিম্পিক দৌড়ে ইংল্যান্ডের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করতে তার নামও উঠেছিল। তিনি প্রায়ই ৫০ কিমি. দৌড়াতেন।
টিউরিং যখন কাজ শুরু করলেন, তখনও দৌড়াতেন। তার কথায়, আমার কাজটি এতো স্ট্রেসফুল যে এই স্ট্রেস থেকে মুক্তির একটাই পথ আমার কাছে, দ্রুত দৌড়ানো, এই একমাত্র পথেই আমি সামান্য শান্তি পাই।
গ্রীক নারী পলিম্যাথ হাইপেশিয়া নিজের জন্য একটি ব্যায়াম প্রোগ্রাম তৈরি করেছিলেন। এতে দৌড়ানো, সাতার, ঘোড়ায় চড়া ইত্যাদি ছিল। তিনি চেয়েছিলেন তার মাইন্ডের মতো বডিকেও ট্রেইন করতে। আলেকজান্দ্রিয়া লাইব্রেরির শেষ প্রধান থিওনের তত্ত্বাবধানে তিনি এই ব্যায়াম প্রোগ্রাম তৈরি করেন।
জার্মান বিজ্ঞানি, যাকে পৃথিবীর অন্যতম সেরা জিনিয়াস হিসেবে ধরা হয়, সেই আইনস্টাইন নিয়মিত বাইকিং করতেন, এবং হাঁটতেন। তার তত্ত্বসমূহের ব্যাপারে তিনি কনভিন্স হতেন বাইকিং করার সময়, এটা তিনি বলেছেন। এমনকি বিখ্যাত আপেক্ষিকতা তত্ত্বের ব্যাপারেই তিনি কনভিন্স হন সাইকেল চালাতে চালাতে। তিনি বলেছিলেন, আমি ওটা নিয়ে ভেবেছিলাম একবার সাইকেল চালানোর সময়।
বিজ্ঞানি পল ডিরাক মধ্যরাতে কোপেনহেগেনের রাস্তায় হাঁটতেন তার কুকুরকে সাথে নিয়ে। আর এই সময়ে তিনি কোয়ান্টাম ফিজিক্সের সমস্যাগুলি নিয়ে ভাবতেন।
বড় দার্শনিক সোরেন কীয়ের্কেগার্ড রাস্তায় হাঁটতেন। প্রায় দুই দশকের মতো তিনি নিয়মিত হেঁটেছেন চিন্তা করার জন্য। কীয়ের্কেগার্ড একবার বলেছিলেন, আমি হেঁটেই আমার সেরা চিন্তাগুলি পেয়েছি। একইকথা দার্শনিক নীৎসেও বলেন, সব সত্যিকার সেরা চিন্তা হাঁটার মাধ্যমেই কনভিন্স হয়।
আর একদিন হাঁটতে গিয়েই তো নীৎসে তুরিন শহরে দেখতে পান একটা লোক তার ঘোড়াকে বেদম প্রহার করছে। এটা দেখে নীৎসের এতই খারাপ লাগে যে তিনি দৌড়ে ঘোড়া ও লোকটির মাঝামাঝি চলে যান। তিনি এই শোকের ধাক্কায় অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। আর সুস্থ হন নি।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও ব্যায়াম সম্পর্কে খুবই পজেটিভ অবস্থান ছিল। তিনি সরাসরি ব্যায়াম করতেন কি না জানি না। তবে বাঙালীর আশা ও নৈরাশ্য প্রবন্ধে তিনি বাঙালী জাতির মুক্তি জন্য যে দুটি উপায়ের কথা বলেছেন এর একটি হলো ব্যায়াম।
যাহা হউক, আমাদের দেশের উন্নতির পক্ষে যে দুইটি বাধা (প্রথম দারিদ্র্য, দ্বিতীয় জলবায়ু বদ্ধমূল হইয়া আছে, তাহা নষ্ট করিবার তেমনি দুইটি অমোঘ উপায় আছে– ব্যবসায় ও ব্যায়াম। – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
এক্সারসাইজ যে ক্রিয়েটিভ থিংকিং, ফ্লুইড ইন্টিলিজেন্স বা ফ্রি ফ্লো অব থটস বাড়ায় এ নিয়ে সাইন্টিফিক প্রমাণ দিন দিন শক্তিশালীই হচ্ছে।