অনেকের মনে এই জিজ্ঞাসা থাকে যে রমজান মাসে বা রোজা রেখে কীভাবে জিম করব। এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েই এই লেখা।
প্রথমে একটু স্মৃতিচারণ,
আমি জিম শুরু করে গত রমজানের আগের রমজান। এক রোজা থেকেই। এর আগেও কয়েকবার শুরু করেছিলাম কয়েক বছর আগে পরে। কিন্তু কন্টিনিউ করা হয় নি। কিন্তু এবারে হয়েছে। এবং রোজায় শুরু করায় হিসাব রাখতেও সুবিধা হল। যেমন, এটা হল তৃতীয় রোজা, অর্থাৎ, প্রায় দুই বছর হল বলা যায়।
রোজায় জিম কেন শুরু করেছিলাম এর উত্তর হল, কোন স্বাস্থ্য উপকারিতার কথা ভেবে নয়। আমি শুরু করব শুরু করব ভাবছিলাম। বন্ধু একজনের সাথে কথা হচ্ছিল। সে আগামী মাস আগামী মাস করছিল। এভাবে করতে করতে সময় যাচ্ছিল। রমজানে মনে হল, যা করা দরকার তা করে ফেলা উচিত। তাই শুরু করেছিলাম। এটা একটা গুড মেসেজ আমার মনে হয়। যা করা দরকার তা করে ফেলা উচিত।
এপ্রিল, ২০১৯
রোজায় কীভাবে জিম করব এই প্রশ্নটি আসে আমার মনে হয় রোজা সম্পর্কে একটা দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। আপনি দেখছেন রোজা না খেয়ে থাকা, কষ্ট, ইবাদত ইত্যাদি হিসেবে। এগুলি সব ঠিক আছে। কিন্তু আরেক দিক থেকেও রোজাকে দেখা যায়।
রোজা হল ভিন্নরকম খাওয়ার তরিকা। ডায়েট পদ্বতি, বা খাওয়ার প্যাটার্ন।
এমনিতে আমাদের স্বাভাবিক তিনবেলা খাওয়াটা একটা খাওয়ার প্যাটার্ন। কিন্তু এটাই একমাত্র প্যাটার্ন না।
ধরেন রোজায় আপনি ১৬ ঘণ্টা না খেয়ে থাকবেন। তাহলে বাকি ৮ ঘণ্টা কী? খাওয়ার উইন্ডো। ওই সময় আপনি দিনের জন্য ক্যালরি নিবেন।
এটা পপুলার ওয়েট লস পদ্বতি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর সাথে মিলে যায়। কিন্তু ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এ পানি ও ব্ল্যাক কফি খাওয়া যায় না খাওয়ার উইন্ডোতেও। রোজায় এটা করা যায় না।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর বেনেফিট অনেক।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কীভাবে ফ্যাট লসে সাহায্য করে?
সহজভাবে বর্ননা করছি।
যখন আপনি খাবার খাচ্ছেন ও আপনার শরীর খাবার এবজর্ব করছে তখন শরীর ফ্যাট বার্ন করতে পারে না। খাবার খাওয়া থেকে শুরু করে প্রায় ৩ থেকে ৫ ঘণ্টা হলো শরীরের খাবার এবজর্ব, ডাইজেস্ট ইত্যাদি করার সময়কাল। এইসময়ে ইনসুলিনের লেভেল হাই থাকে। এজন্য শরীর ফ্যাট বার্ন করতে পারে না।
এই সময়কালের পরে শরীর চলে যায় পোস্ট-এবজর্বটিপ স্টেইজ । যেটা হল খাবার খাওয়ার প্রায় ৮ ঘণ্টা পর। তখন ইনসুলিন লেভেল লো থাকে, এবং শরীর ফ্যাট বার্ন করতে পারে।
যখন আপনি রাতে খেলেন সারাদিন না খেয়ে থাকলেন, তখন পোস্ট এবজর্বটিপ স্টেইজ হল অনেক লম্বা। শরীর তখন ফ্যাট বার্ন করার সুযোগ পায় বেশি। এ কারণে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এ, অর্থাৎ দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকলে ফ্যাট কমে দ্রুত।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এ জীবনকাল দীর্ঘ হয় এমন দেখা গিয়েছিল ১৯৪৫ সালের একটি রিসার্চে। ইঁদুরের উপর পরীক্ষাটি করা হয়েছিল। ২০০৬ সালের আরেকটি রিসার্চেও দেখা গেছে ফাস্টিং জীবনকাল বাড়াতে ধনাত্মক প্রভাব ফেলে।
এখানে আমি আবার ক্লিয়ার করি, ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এ পানি, ব্ল্যাক কফি ইত্যাদি খাওয়া যায়। ইসলাম ধর্মের যে রোজা তাতে কিছু খাওয়া যায় না রোজাকালীন সময়ে।
এবং ধর্মের না খাওয়ার এক আধ্যাত্মিক গুরুত্ব আছে। এটি স্বাস্থ্যের জন্য নয়, বা দুনিয়াবি সুবিধার জন্য নয়। একটি ধর্মীয় মেসেজ আছে এই রোজা পালনের পেছনে, যেটির গুরুত্ব স্বাস্থ্য বা এই ধরণের সংকীর্ণ জিনিসের উপরে। যেমন, গরীবেরা যে না খেয়ে আছে এটা অনুভব করতে পারা।
আমি তত্ত্বীয় কথা বলছি। মানুষ কীভাবে পালন করে তার কথা বলছি না। কারণ মানুষের পালনে কতটুকু যথাযথতা রক্ষিত হয়, কতটুকু সেই মূল মেসেজটা তারা মনে রাখেন, আমি এ ব্যাপারে কিছুই বলতে চাই না।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর চাইতে কিছু ক্ষেত্রে আলাদা হলেও একেবারে ১০০ ভাগ আলাদা এমন নয় রোজা। রোজাও ফাস্টিং, এবং ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং যেমন হিউম্যান গ্রোথ হরমোন থেকে কোষীয় লেভেলে প্রভাব ফেলে রোজাও তেমনি প্রভাব ফেলে।
পৃথিবীর নানা ধর্মে ও কালচারে না খেয়ে থাকার বা ফাস্টিং এর রীতি আছে হাজার হাজার বছর ধরে। এই রীতিটি লিন্ডি প্রুফ। লিন্ডি ইফেক্ট হচ্ছে একটি ধারণা যা বলে কোন আইডিয়া, চিন্তা যতদিন ধরে প্রচলিত আছে, আরো ততদিন প্রচলিত থাকবে। যেমন সক্রেটিস এর চিন্তা ধরা যাক ২৫০০ বছর ধরে মানব সভ্যতায় আছে, তাহলে আরো ২৫০০ বছর থাকবে। ফাস্টিং এর ধারণাও এমন।
এর ফ্যাট লসের ক্ষেত্রে যে হেলথ বেনিফিট তার কথা নানা গবেষণায় দেখা গেছে। কিন্তু মার্কেটিং এ আপনি দেখবেন না ফাস্টিং করে ফ্যাট কমান বা ওয়েট লস করুন এর বিজ্ঞাপন।
কারণ, ফ্যাট বার্নিং ও ওয়েট লসের বিরাট এক মার্কেট আছে। অনেক কোম্পানি এতে কাজ করছে। তারা বিজ্ঞাপন দিবে তাদের পণ্য বিক্রির জন্য। আপনার উপকারের জন্য নয়। ফাস্টিং করে আপনি ওয়েট লস করতে পারলে তাদের লাভটা কী?
লাভ নাই।
ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং নিয়ে Thomas DeLauer এর ইউটিউব চ্যানেলটি ভালো। সেখানে মাসল বিল্ডিং থেকে শুরু করে ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং কীভাবে নানাভাবে সাহায্য করে হেলথে তা বুঝানো আছে।
[ একটু বিবর্তগত কারণের দিকে দেখার যাক। মানুষ হিসেবে আমাদের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস কী বলে খাওয়ার প্যাটার্ন নিয়ে। আমেরিকার উটা স্টেইটের একটি নন প্রফিট প্রতিষ্ঠান ইন্টারমাউন্টেইন হেলথেকেয়ার সিস্টেম। এর কার্দিওভাস্কুলার এন্ড জেনেটিক এপিডেমিওলজির ডিরেক্টর বেনজামিন হর্ন বলেন এর ব্যাখ্যা হল, ফাস্টিং যে ভালো এর যুক্তি বিবর্তনের দিক থেকে বুঝা যায়। হান্টার গেদারার সমাজে খাবার সংগ্রহ করা সহজ ছিল না। এখনকার মত প্রচুর খাবার ছিল না। মানুষকে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে হত। এই অবস্থায় যারা টিকেছে, তাদের সন্তানদেরও দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকতে পারার ক্ষমতা জন্মেছে। এবং এই দিক থেকে দেখলে দীর্ঘ সময় না খেয়ে থাকা তাদের স্বাস্থ্যের জন্য ভালো আপনি আশা করতে পারেন। টাইম ম্যাগাজিনে আছে এই বক্তব্য।]
এখন আমার কথা কী রোজায় জিম করা নিয়ে?
কথা হলো, যেহেতু ধর্মীয় কারণে আপনি ফাস্টিং করার একটি মহাসুযোগ পেয়েছেন (কারণ এমনিতে না খেয়ে থাকা আরো বেশি কঠিন মনোবলের দিক থেকে) এটি ওয়েট লস বা ফ্যাট বার্নিং এর কাজে লাগান।
এখানে রাতে আপনি ইচ্ছামত খেতে পারবেন।
তবে খাবার সময়ে স্বাভাবিক নিয়মে যা বলা হয়, ভাজা পোড়া, তেলজাতীয় ইত্যাদি খাবার কম খেয়ে শাক সবজী জাতীয় ভালো খাবার বেশি খান। বেশি প্রোটিন খান।
এক্সারসাইজ করতে পারেন রাতে। কারণ দিনে করা কঠিন হবে এই গরমে। পানি পিপাসা পেতে পারে। আর যেহেতু এটি রোজা তাই আপনি ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এর মত পানি খেতে পারবেন না, অতএব দিনে এক্সারসাইজ না করাটাই আমার মতে বেটার। তারাবির পর থেকে ১২ টা বা ২ টা পর্যন্ত অনেক জিম খোলা থাকে।
রোজা ত্রিশ দিন হলে ৪ সপ্তাহ। আর সপ্তাহে চারদিন করলে আপনি ১৬ দিন এক্সারসাইজ করবেন। সপ্তাহে দুই দিন রেস্ট নিতে পারেন। ( বা তিনদিন করে, তিনদিন রেস্ট নিতেও পারেন। )
১৬ দিনে ১৬ ঘণ্টা।
এক্সারসাইজ করা শুরু করলে অবাক হয়ে দেখতে পাবেন,
আপনার শক্তি কমে যায় নাই।
আপনি রোজা না থাকায় অবস্থায় যেমন এক্সারসাইজ করতে পারতেন, তেমনি এক্সারসাইজ করতে পারছেন। দেখবেন জিমের সবাই এমনই করতে পারছে।
কারণ, রাতে তো আপনি অনেক ক্যালরি নিচ্ছেন। হিসাব করলে দেখা যাবে আগে দিনে যা নিতেন প্রায় সে পরিমাণই নিচ্ছেন। ফলে শক্তি কমবে না। শক্তির ব্যাপারটা আবার মানসিক। আপনি যদি ভাবে আমার শক্তি নাই, কমে গেছে, তাহলে শক্তির মাকে খুঁজে পাবেন না সহজে।
তাহলে শেষকথা কী,
রোজায় এক্সারসাইজ করতে কোন বাঁধা নেই।
রোজা ফ্যাট লসের জন্য এক বিরাট সুযোগ নিয়ে আসে।
রোজা এবং ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং এক না হলেও একই রকম।
রোজার ধর্মীয় মূল্য তথা আধ্যাত্মিক মূল্যকে স্বাস্থ্যগত সুবিধা ইত্যাদি দিয়ে ছোট করা যাবে না, যেহেতু ধার্মিকদের কাছে এর আধ্যাত্মিক মূল্য অনেক বেশি। অনেক কম বুঝা মানুষেরা রোজার স্বাস্থ্যগত গুণাগুণ সত্য মিথ্যা ফলা করে বেড়াও আর ভাবে রোজাকে তারা বড় করল। কিন্তু আসলে ছোট করে। প্রকৃত ধার্মিকেরা ধর্ম পালনের জন্যই আচার পালন করেন, এর দুনিয়াবি সুবিধার জন্য নয়। আমার এই পোস্টকে তাই রোজার গুণাগুণ বা দুনিয়াবি মাহাত্ম্য বর্ণনার পোস্ট হিসেবে দেখা যাবে না।
[বি দ্র বা ফান নোটঃ অনেক ধরণের খাবারের প্যাটার্ন বা ডায়েট পদ্বতি চালু আছে ও নিত্য নতুন আসছে। নিউট্রিশন সাইন্স এখনো দৃঢ় কিছু না। নানা ধরণের ভিন্ন ভিন্ন মত এখানে আছে। কেউ দিনে একবেলা খাবারের পক্ষে, কেউ দুইবেলা, কেউ শুধু প্রোটিন খাওয়া ও কার্ব একেবারে নাই করে দেয়ার পক্ষে। ইত্যাদি নানা মত। তবে, এরকম ডায়েট জনিত কিছু করার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। আপনার ডাক্তারকে ফোন দিয়ে বলতে পারেন, এবার ডাক্তার সাহেব, আপনিই বলেন আমি নিজেরে নিয়া কী করব?]
কৃতজ্ঞতাঃ এই সাইটের একজন পাঠক Mostafa Ovi, তার প্রশ্নের উত্তরেই এই লেখাটি হল।