দর্শনের আলাপে কেউ যদি জিমের বা শারীরিক ট্রেইনিং এর কথা বলে, আপনি হয়ত বলবেন, কই আলাপ করবে থিওরিটিক্যাল বিষয় নিয়া, শুরু করছে বাস্তবের জিনিশ জিমের আলাপ। এই আপত্তিটা এখন স্বাভাবিক। কিন্তু আপনি যদি সক্রেটিসের সময়ে, বা প্রাচীন গ্রীসের দার্শনিকদের সময়ে বাস করতেন, তাহলে এই প্রশ্ন আপনার মনে আসার অবকাশই থাকত না। আপনি দেখতেন সব দার্শনিকেরাই জিম, ডায়েট নিয়ে বিস্তর আলাপ করে যাচ্ছেন। এবং আপনি লক্ষ করতেন তাদের কাছে দর্শন হচ্ছে, ভালো জীবন যাপনের বিজ্ঞান।
প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকদের জানার জন্য যে বই সবচাইতে বেশি ব্যবহৃত হয়, ডায়োজিনিস লয়েরতিয়াসের, লাইভস এন্ড অপিনিয়ন্স অব এমিনেন্ট ফিলোসফার; এই বই যদি আপনি পড়েন, তাহলে দেখবেন দার্শনিকেরা মাইন্ড ও বডিকে আলাদা করে দেখতেন না। তারা মনে করতেন ভালো চিন্তা করতে হলে যেমন ভালো বই বা জ্ঞানীদের কাছে গিয়ে শিখতে হবে, তেমনি দরকারী শারীরিক ট্রেইনিং ও ভালো ডায়েট। অন্যথায় ভালো চিন্তা সম্ভব না।
সক্রেটিস থেকে শুরু করা যায়, তিনি বলছিলেন এইটা লজ্জাজনক যদি কেউ তার বডির ক্যাপাবিলিটি না দেখে বুড়া হয়ে যায়। নিজের এই কথার সাপেক্ষে জীবন যাপন করেছিলেন সক্রেটিস। দার্শনিক হবার আগে তিনি একজন যোদ্ধা হিসেবে পরিচিত ছিলেন, এবং যুদ্ধে তার ভালো পারদর্শীতা ছিল। কয়েকজনকে তিনি যুদ্ধে বাঁচিয়েছিলেন, এর মধ্যে আছে এথেন্সের সেই সময়ের বিখ্যাত এলসিবিয়াদেসও।
সিনিক এবং স্টোয়িকেরা তাদের দর্শনের সাথে নিবিড়ভাবে যুক্ত করে রেখেছিলেন শারীরিক ট্রেইনিংকে। সিনিক দার্শনিক ডায়োজিনিস অব সিনোপ প্রসঙ্গে একটা অংশ ডায়োজিনিস লয়েরতিয়াসের বই থেকে এখানে উল্লেখ করা যায়।
লয়েরতিয়াস ডায়োজিনিস অব সিনোপের দর্শন বিষয়ে লিখেছেন,
তিনি প্রায়শই বলতেন দুই ধরণের ট্রেইনিং দরকার, মেন্টাল ও শারীরিক। নিয়মিত শারীরিক ট্রেইনিং এর মাধ্যমে মানসিক গঠন তৈরি হয় তা ভার্চুয়াস কাজের দিকে উদ্বুদ্ধ করে। এই দুইটার মধ্যে একটা যদি না থাকে তাহলে অন্যটার ফল ঠিকমত আসে না। ভালো স্বাস্থ্য ও শক্তি আত্মা ও শরীর দুইটার জন্যই অপরিহার্য। তিনি বলতেন, শারীরিক ট্রেইনিং ভার্চ্যু অর্জনের পথকে সহজ করে দেয়। এর উদাহরণ হিসেবে তিনি বিভিন্ন কারিগর ও শিল্পীয়ের কথা বলতেন, যে কীভাবে তারা নিয়মিত পরিশ্রম, ট্রেইনিং এর মাধ্যমে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। বা কীভাবে ক্রীড়াবিদ ও বংশীবাদকেরা নিয়মিত ট্রেইনিং দ্বারা তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অসাধারণ হয়ে উঠেন। জীবনে কোন কিছুই ট্রেইনিং ছাড়া সফল হয় না। পর্যাপ্ত ট্রেইনিং এর মাধ্যমে যেকোন বাঁধা অতিক্রম সম্ভব। এইসব তিনি বলতেন, ও বলাবাহুল্য, এই কথাগুলি নিজের জীবনে মেনে চলতেন, হারকিউলিসের মত, কারণ তিনি তার স্বাধীনতাকেই জীবনের সর্বোচ্চ মঞ্জিল হিসেবে স্থির করেছিলেন।
উপরে ডায়োজিনিস লয়েরতিয়াস এর লেখা থেকে বুঝা যায়, ডায়োজিনিস অব সিনোপের শারীরিক ট্রেইনিং ও মেন্টাল ট্রেইনিং দুইটাকেই অপরিহার্য ধরেছেন মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য।
দর্শনের কাজ কী? মানুষকে স্বাধীন করা। এবং এই স্বাধীনতা অর্জন তার সম্ভব হবে না যদি সে কেবল থিওরিটিক্যাল ও মেন্টাল দিকে লক্ষ দেয়। কারণ তার বডিতেই তারে বাস করতে হয়, এবং তারে দেহ ধারণ করতে হলে খেতে হয় খাদ্য।
এটা একটা কমন সেন্সের বিষয়ই যে মানুষের খাওয়া, স্বাস্থ্য তার চিন্তায় প্রভাব ফেলবে। আমরা দেখি যখন আমাদের শরীর অসুস্থ থাকে তখন মানসিক অবস্থা ভালো থাকে না, কিংবা, বিভিন্ন খাবারের বিভিন্ন ধরণের প্রতিক্রিয়া হয় শরীরে। প্রাচীন চৈনিক দর্শনে খাবার এবং ওষুধ আলাদা করা হতো না, দুইটা এক হিসেবে দেখা হত।
শারীরিক ট্রেইনিংকে দর্শন বা চিন্তা থেকে আলাদা করা ও কেবল থিওরিটিক্যাল আলাপে নিয়ে যাওয়া একটা আধুনিক ধারণা। কিন্তু শিল্প বিপ্লবের পরে যখন মানুষ দেখতে পেলো এর ভয়ংকর দিকটা, মানুষকে যন্ত্রের মত কাজ করানো হচ্ছে, খাবার দূষিত হচ্ছে, পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, তখন কিছু বুদ্ধিমান লোক ক্ল্যাসিক্যাল দর্শনের মূল জায়গা, শরীর ও মাইন্ডের সংযোগে ফেরত যেতে চেয়েছিলেন। তারা অনুভব করেছিলেন শারীরিক ট্রেইনিং, স্বাস্থ্য ও ভালো খাবারের প্রয়োজনীয়তা। জর্মন দেশের শিক্ষাবিদ জোহান ক্রিস্টফ ফ্রেডরিক গাটসমুথের একটা মুভমেন্ট ছিল ফিজিক্যাল এক্সারসাইজকে গুরুত্ব দিয়ে।
নিও প্লেটোনিস্টেরা তাদের দার্শনিক নীতিমালায় এক্সারসাইজকে রেখেছিলেন, তাদের মতে এটা ছিল শরীরকে শুদ্ধ করা। ড্যানিশ দার্শনিক কীয়ের্কেগার্ড দীর্ঘ সময় হাঁটতেন, জর্মন দার্শনিক নীতশেও লম্বা হাঁটায় যেতেন ও এক্সারসাইজের গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কীয়ের্কেগার্ড তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন,
Above all, do not lose your desire to walk. Every day I walk myself into a state of well-being and walk away from every illness. I have walked myself into my best thoughts, and I know of no thought so burdensome that one cannot walk away from it.