ওরেঞ্জ বা কমলালেবু একটি বিখ্যাত ফল। বাংলাদেশের হাটে বাজারে ও কমলালেবুর গাছে এই ফল দেখা যায়। এর পুষ্টিগুণ খুবই ভালো। ‘দুনিয়ার স্বাস্থ্যকর খাদ্যের’ ওয়েবসাইটে গিয়ে এর গুণাগুণ পড়তে পড়তে আমার মনে হলো, এ তো এক কুদরতি ফল। তাই তাকে নিয়ে এই লেখা।
কমলালেবুতে সবচেয়ে বেশী ভালো যে জিনিস আছে তা হলো ভিটামিন সি। খুবই উন্নত মানের ভিটামিন সি। স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যের রেটিং এ কমলালেবুতে থাকা ভিটামিন সি এর রেটিং “এক্সেলেন্ট”।
রক্তের সুগার লেভেলে কমলালেবুর প্রভাব খুব কম। তাই এর গ্লাইকোমিক ইনডেক্স রেটিং হচ্ছে নিম্ন বা লো। রক্তে সুগার লেভেলে কোন শর্করা খাদ্যের প্রভাব কেমন তার ভিত্তিতে গ্লাইকোমিক ইনডেক্স এ একটা রেটিং দেয়া হয়। রেটিং হাই হলে সেই শর্করা খাদ্য রক্তের সুগার লেভেল বাড়াতে পারে।
কমলালেবুর কিছু গুণাগুণঃ
১। হৃদরোগ প্রতিরোধের জন্য ভালো।
২। কোলেস্টেরল লেভেল কম রাখার জন্য ভালো।
৩। কমলালেবুতে ডায়েটারী ফাইবার থাকে, তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
৪। কিডনীর পাথর প্রতিরোধের জন্য ভালো।
৫। আলসার ও পাকস্থলীর ক্যানসার প্রতিরোধের জন্য ভালো।
৬। শ্বাসযান্ত্রিক স্বাস্থ্যের জন্য ভালো।
৭। Rheumatoid Arthritis প্রতিরোধের জন্য ভালো।
এইসব গুণাবলী দেয়া আছে বিশ্বের স্বাস্থ্যকর খাদ্যের ওয়েবসাইটে। এখন বলেন এতো গুণ যার তাকে কুদরতি ফল না বলে কী বলা যায়?
তবে, বেশী খুশি হবার আগে জেনে রাখুন, সাইটে সব গুণের আগে সম্ভাব্য বা পসিবল কথাটি জুড়ে দেয়া আছে। ফলে অন্যান্য বাংলা সাইটের মত আমি কমলালেবুর গুণ গাইতে গিয়ে বলছি না যাবতীয় সব অসুখে ওষুধের মতো কার্যকর সে। বলছি, বৈজ্ঞানিক ভাবে গবেষণায় দেখা গেছে উক্ত রোগসমূহ প্রতিকারে-প্রতিরোধে কমলালেবুর “সম্ভাব্য” ভালো প্রভাব থাকতে পারে। সব বৈজ্ঞানিক কাজ ও গুণাগুণের রেফারেন্স ওয়ার্ল্ড’স হেলদিয়েস্ট ফুডস ওয়েবসাইটের কমলালেবু পেইজ।
বডি বিল্ডিং এ কমলালেবুঃ
কমলালেবু একজন খেতে পারেন কেবল উন্নত মানের ভিটামিন সি’র জন্যই।
এছাড়াও কমলালেবু একটি ভালো প্রি-ওয়ার্কআউট ফল। জিমে যাবার ঘন্টাখানেক আগে কমলালেবু খেলে ভালো।
ভিটামিন সি এর নানা স্বাস্থ্য উপকারের কথা প্রায় সর্বজনবিদিত। ভিটামিন সি ব্যায়ামের মাসল রিকভারির ক্ষেত্রেও ভালো প্রভাব রাখতে পারে।
দুই সপ্তাহের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, যারা ৪০০ গ্রাম ভিটামিন সি নিয়েছিল প্রতিদিন তাদের ব্যায়ামের মাসলের কর্মক্ষমতা বেড়েছে ও ব্যথা কমেছে বেশি।
ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ড মেডিক্যাল স্কুলের এক গবেষণা বলে ভিটামিন সি স্বাস্থ্যকর হাড় ও দাতের জন্য দরকারী। এছাড়াও তারা শরীরে টিস্যু রিকভারির কাজে সহায়তা করে ভিটামিন সি।
একটি মাঝারি কমলালেবুতে প্রায় ৬৯ গ্রাম ভিটামিন সি থাকে, এবং তা ভিটামিন সি সাপ্লেমেন্ট থেকে ভালো।
কমলালেবুতে ভালো পরিমাণ পটাশিয়াম থাকে। এই পটাশিয়াম ইলেক্ট্রোলাইট হিসেবে কাজ করে শরীরের পানির লেভেল রিস্টোর করতে সাহায্য করে। তাই ব্যায়ামের পরেও কমলালেবু খাওয়া যেতে পারে।
কমলালেবু ও আর্ট
ইউরোপের রেনেসাকালীন সময়ের ছবিতে তথা রেনেসা পেইন্টিং এ কমলালেবুর ছবি আছে। তা দেখে ভ্রম হতে পারে কমলালেবু পশ্চিমা ফল। কিন্তু তা নয়। কমলালেবু এশিয়ান ফল। হাজার হাজার বছর আগে দক্ষিণ পূর্ব চীন/আসাম হতে ইন্দোনেশিয়া, ভারতে পৌছায়।
মধ্যপ্রাচ্যে পৌছায় অনেক পরে, প্রায় ৯ শতকের আগে ওখানে কমলালেবুর চাষ ছিল না। মিষ্টি কমলালেবু ইউরোপে পৌছায় প্রায় ১৫ শতকে।
আর্টে কমলালেবুর প্রতীকী অর্থ হিসেবে অনেকে বলেন এটি ফ্রি উইলের প্রতীক।
লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির বিখ্যাত দ্য লাস্ট সাপার ছবিতেও টেবিলে কমলালেবু রয়েছে। এছাড়াও বতিচেল্লির প্রিমেভেরা বা বসন্ত ছবিতে, ডমিনিকো বেনজিয়ানোর সেইন্ট লুসি অল্টারপিসের মতো অসাধারণ ছবিতেও দেখা যায় কমলালেবু।
কমলালেবু ও বাংলাসাহিত্য
বাংলা সাহিত্যে যেসব ফলের কথা আছে তার মধ্যে কমলা লেবু অন্যতম বিখ্যাত। এই খ্যাতির পেছনে আছেন কবি জীবনানন্দ দাশ। তার কবিতায় তিনি অসুস্থ রোগীর বিছানার পাশে কমলালেবু হওয়ার আকাঙ্খা ব্যক্ত করে গেছেন।
একবার যখন দেহ থেকে বার হয়ে যাব
আবার কি ফিরে আসব না আমি পৃথিবীতে?
আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।
কমলালেবু; জীবনানন্দ দাশ, কাব্যগ্রন্থঃ বনলতা সেন (১৯৪২)
সৈয়দ মুজতবা আলী শান্তিনিকেতনে পড়তে গিয়েছিলেন। সেখানে তিনি পাঁচ বছর ছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাকে খুব স্নেহ করতেন। যাবার কয়েকদিনের মধ্যে একদিন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সিলেটি টানের বাংলা শুনে সবার সামনেই বলেছিলেন “কিরে, তোর বাংলায় তো এখনও কমলালেবুর গন্ধ রয়েছে।”
পাহাড়ী এলাকায় কমলা লেবু চাষ হয়। বাংলাদেশের জাফলং, মৌলভিবাজার, জৈন্তা ইত্যাদি কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত। সেই সূত্রেই রবি ঠাকুর সিলেটি টানকে কমলা লেবুর সাথে মিলিয়েছিলেন।